মোঃ সোলেমান আলী (খোকন): সাহিত্য সমাজের দর্পন স্বর। সাহিত্য জীবনের প্রতিচ্ছবি হিসেবে মানব মনের গভীর অনুভূতিগুলো নানাভাবে রাজ করে। সমাজ জীবনের সঙ্গে মানুষের আত্মার অনিচ্ছা সম্পর্ক কৃষি করেছেন সাহিত্যে। কিন্তু সাহিত্য সৃষ্টিলগ্ন থেকে বর্তমান সময়ে নানা দিকে রদবদল হয়ে তার সৃষ্টিশীলতাকে এটার (লেখকের) মধ্য দিয়ে বিকশিত হচ্ছে।
বাংলা ভাষার ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস। বর্তমানে পৃথিবীতে সাড়ে তিন হা বেশি ভাষা প্রচলিত আছে। বাংলা ভাষাভাষীর দিক দিয়ে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছে। শুধু তাই নয় এখন পৃথিবীতে প্রায় ত্রিশ কোটি লোকের মুখের ভাষা বাংলা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দিয়েছে সিয়েরালিওনের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলার গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাস ও মাধুর্য লক্ষ্য করে জাতিসংঘের শিক্ষা বিষয়ক সংগঠন ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর কানাডার প্রবাসী বাঙালীদের প্রচেষ্টায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ। ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের রয়াল লাইব্রেরী থেকে তদানীন্তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বইটি আবিষ্কার করেন। চর্যাপদের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয়। চর্যাপদগুলোর ভাষা, রচনাশৈলী, শব্দবিন্যাস ও সমাজচিত্র যেভাবে প্রদর্শিত হয়েছে তৎকালীন সাহিত্যধারায় তা খুবই বিরল। চর্যাপদের আবিষ্কারের পর এর রচনাশৈলী ও ভাষা নিয়ে নানাভাষার পণ্ডিতরা নানা ধরনের যুক্তিতর্ক দিয়ে এটিকে তাদের নিজেদের বলে দাবী করেছিলেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধায় তাঁর ODBL গ্রন্থে প্রথম প্রমান করে যে এটি ছিল মূলত বাংলা- ভাষা বা সাহিত্যের বই। যা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক নতুন ধারার বিকাশ সাধন করেন। চর্যাপদের পর বাংলা সাহিত্য গগনে আবির্ভাব ঘটে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য ছিল মূলত বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের আদি নিদর্শন। এটির আবিষ্কার হয় ১৯০৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া নামক জেলার কাকিল্যা নামক গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়াল ঘরের চালা থেকে। এটি আবিষ্কার করে বসন্তরঞ্জন বিষবল্পত। চর্যাপদ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের যাত্রা শুরু হলেও তা সেখানে থেমে না থেকে নানা দিকে বিকশিত হয়। প্রাচীনযুগ ও মধ্যযুগ ছিল মূলত কাব্যিক ও ধর্ম ভিত্তিক সাহিত্য।
মধ্যযুগের শুরুতেই মূলত তুর্কি শাসক ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলা বিজয়ের (১২০৩/১২০৪) ফলে বাংলা সাহিত্যাকাশে অস্থকারের বিমূর্ত ছায়া নেমে আসে। বাংলা সাহিত্যে যা অন্ধকার যুগ (১২০১-১৩৫০) নামে পরিচিত। যদিও বাংলা সাহিত্যে অন্ধকার যুগ বলে আধুনিক কালের পণ্ডিতগণ কোন যুক্তি স্বীকার করেন না। ভাষার বহমান প্রক্রিয়ায় বাংলা ভাষা মুখ থুবরে পরে থাকেনি। মঙ্গল সাহিত্য থেকে শুরু করে অনুবাদ সাহিত্য, নাথ সাহিত্য, মর্সিয়া সাহিত্য, জীবনী সাহিত্য, রোমান সাহিত্য, লোকসাহিত্য, কবিগান, পদাবলী সাহিত্য, বটতলার পুঁথি সাহিত্য, দো-ভাষী পুঁথি সাহিত্য, রোমান্টিক কাব্য সবই মধ্য যুগের সৃষ্টি। শুধু তাই নয় বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যগুলো আধুনিক গীতি কবিতার আদি নিদর্শন।
১৮০০ সালের ৪ মে লর্ড ওয়েলেসলি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এই কলেজেই মূলত বাংলা গদ্য রচনার সূত্রপাত ঘটে। এখান থেকেই বাংলা সাহিত্যের গদ্যের চলমান তারকারাজী সাহিত্যাকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে বিকাশ সাধন করে। এরপরে ১৮০১ সালের ২৪ নভেম্বর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগ খোলা হয়। উইলিয়াম কেরীকে বাংলা বিভাগে অধ্যক্ষ করে কলেজের কয়েকজন পণ্ডিত মিলে বাংলা ভাষার কিছু দুর্লভ বই রচনা করেন। পণ্ডিতদের রচিত বইগুলো হল-উইলিয়াম কেরী-কথোপকথোন (১৮০১), ইতিহাসমালা (১৮১২), রামরাম বসুর রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র, লিপিমালা, গোলকনাথ শর্মার হিতোপদেশ, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার এর-বত্রিশ সিংহাসন, হিতোপদেশ, রাজাবলি, চণ্ডীচরণ মুন্সীর-তোতাকাহিনী, উল্লেখিত বইগুলো ছিল মূলত বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রতন।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পর রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ বাংলা গদ্য সাহিত্যের ধারাকে বিকশিত রূপ দান করেন। তিনিই মূলত বাংলা ভাষায় রচিত বাংলা ব্যাকরণ “গৌড়ীয় ব্যাকরণ” (১৮৩০) রচনা করেন, যা ব্যাকরণের ইতিহাসে বিরল। ইনি মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর রেঁনেসার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের গদ্যরীতির জনক ও বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত প্রথম গদ্যশিল্পী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০- ১৮৯১)। বাংলা গদ্যের রূপ-রস-গন্ধ যাঁর হাতে পেয়েছিল এক নতুন সূচনা। বিদ্যাসাগর গদ্য রচনার শুরুতেই মূলত অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি গুরুত্ব দেন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন যে বিদেশী সাহিত্যের যে গ্রন্থগুলো খ্যাতি অর্জন করে আছে সেগুলো অনুবাদ করে শব্দচয়ন ও রচনাশৈলী দেখে বাংলা গদ্য সাহিত্যকে বিকশিত করতে হবে। তাই তো তিনি-বেতাল পঞ্চবিংশতি (১৮৪৭), শকুন্তলা (১৮৫৪), সীতার বনবাস (১৮৬০), ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯) বইগুলো অনুবাদ করেন। এরপর তিনি বাংলা ভাষায় মৌলিক সাহিত্য প্রভাবতী সম্ভাষণ, বিদ্যাসাগর চরিত, বর্ণ পরিচয় রচনা করেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পর থেকে দিনের পর দিন বাংলা সাহিত্য বিকশিত হতে থাকে।
১৮৬৫ সালে বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাস প্রকাশিত হয়। যা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস। যদিও প্যারীচাঁদ মিত্র ১৮৫৮ সালে ‘আলালের ঘরে দুলাল’ উপন্যাস রচনা করেন। এটি মূলত বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস। কিন্তু সাহিত্যিক বিচারে এটি সার্থক হতে পারেনি।
বঙ্কিমের পর থেকে নানা সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যকে আজকের এই অবস্থায় নিয়ে এসেছেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কায়কোবান, কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু, জসীম উদ্দীন এঁর মত প্রাণপুরুষগণ বাংলা সাহিত্যের অমর লেখক।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হল আজকে আমরা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ বাংলা ভাষা চর্চা বাদ দিয়ে নানা ধরনের বিদেশী ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য পাগল প্রায়। আমরা সন্তানদের জন্মের পর থেকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুমধুর ডাক “মা” কে মাম্মী বলতে শেখাই, বাবাকে ড্যাডি, চাচা মামার পরিবর্তে Uncle, মাসি পিসির পরিবর্তে Aunty শেখাই। আজকে আমরা ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে পারলে সমাজে নিজেকে সবচেয়ে Modern বাবা-মা বলে পরিচিত করতে পারি। এতে আমরা ক্ষ্যান্ত থাকি না, ছেলে-মেয়েরা যেন সব সময় ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারে সে জন্য ইংরেজি সংস্কৃতির সংস্পর্শে মিলিয়ে দেই। বিদেশীদের মত পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করাই যেন ছেলে-মেয়েদের ইংরেজ-ইংরেজ মনে হয়। এমনকি আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সব ধরনের অফিস আদালতে বাংলা ভাষার চর্চা নেই বললেই চলে। বিভিন্ন চাকুরীর পরীক্ষায় ইংরেজিতে কথা বা পরিচয় দিতে না পারলে তাকে যোগ্য প্রার্থী মনে করি না। অথচ এই ভাষার জন্য বাংলার দামাল ছেলেরা ১৯৫২ সালে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল। বাংলার ইতিহাস মূলত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। অথচ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা আমরা বাদই দিয়েছি।
তাই আসুন আমরা আবার নতুন করে সবাই মিলে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় ব্রতী হই। আমাদের ছেলে- মেয়েদের জন্মের পর Hi Hello না শিখিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলতে আগ্রহী করি।
(লেখক: মোঃ সোলেমান আলী (খোকন), সহকারী শিক্ষক (বাংলা), লালমনিরহাট সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, লালমনিরহাট।)